ইমাম খাইর, কক্সবাজার ::
রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ির পানেরছড়া এলাকার অধিকাংশ মানুষ নিম্নমধ্যবিত্তের। বিকল্প আয়রোজগারের তেমন ব্যবস্থা বলতে নেই। বেশিরভাগের জীবন জীবিকা পানের বরজ নির্ভরশীল। অনেকটা বংশানুক্রমিকভাবে তারা এই কাজ করছে। কিছু মানুষ হাল-চাষ, ক্ষেত খামার করলেও বিকল্প নেই।
কিন্তু হঠাৎ সোমবার (১২ জুলাই) পানেরছড়া তুলাবাগান এলাকার চারটি পানের বরজ উচ্ছেদ করেছে বনবিভাগ। করোনাকালে মানুষ ঘরবন্দি। কোন ধরণের আয় নেই। ঠিক এমন সময়ে অনেকের একমাত্র জীবির অবলম্বন পানের বরজ উচ্ছেদ কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছে না।
পঞ্চাষোর্ধ নুরুল ইসলাম বলেন, ৪০ বছর ধরে পানের বরজ করছি। আমার ২ ছেলে ও ২ মেয়ের সংসার কোনমতে চালাচ্ছি।
তিনি বলেন, দুই দিন আগে ১০ হাজার টাকা চায় রেঞ্জারের ছোট ভাই ইমদাদুল হাসান রনি। টাকা দিতে না পারায় সংসার চালানোর একমাত্র উপায় পানের বরজটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে।
একই অভিযোগ করলেন মোহাম্মদ হোসেন (৩৫) নামের আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি।
তিনি বলেন, করোনার এই দুঃসময়ে সব কাজকর্ম বন্ধ। সংসারে ঠিকমতো খাবার জোগান দিতে পারছিনা। হাতে যা টাকা ছিল সব পানের বরজে খরচ করে ফেলেছি। ইতোমধ্যে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন রেঞ্জ অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান টগর। টাকা দিতে না পারায় দুইটি বরজ ধংস করে দিয়েছে। তিন মেয়ের সংসার কিভাবে চালাব?
২ ছেলে ৩ মেয়ের সংসার নুরুল হাকিমের (৪৫)। একমাত্র জীবিকার মাধ্যম পানের বরজ। প্রায় ১ লাখ টাকা ব্যয়ে পানের বরজ করেছেন। সোমবার (১২ জুলাই) বরজটি গুড়িয়ে দিয়েছে বনকর্মীরা। নুরুল হাকিমের জীবিকার একমাত্র অবলম্বনটি যেন নিঃশেষ করে তাকে পথে বসানো হল। চোখে মুখে ঘোর অন্ধকার হাকিমের। এত বিরাট সংসারের ঘানি টানবে কি করে? ভেবে কূল পায় না।
মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) দুপুরে কথা হয় পানচাষি নুরুল হাকিমের সঙ্গে। পানের বরজ উচ্ছেদের কারণ তুলে ধরেছেন। বলেছেন বিস্তারিত।
তার অভিযোগ, কয়েকদিন আগে ২০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন বন বিভাগের পানেরছড়া রেঞ্জ অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান টগর। দাবি মেটাতে না পারায় স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
নুরুল হাকিম বলেন, আমার অনেক ধারদেনা। কিস্তির টাকায় ভূমিহীন খতিয়ানভুক্ত জমিতে পানের বরজ করেছি। চাষের শুরুতেই বরজ ভেঙ্গে সব মাটি করে দেয়া হয়েছে। যাওয়ার কোন রাস্তা নাই। কি করে সংসার চালাবো?
প্রতিবেদককে দেখে দুঃখ বর্ণনা দিলেন পান বরজের শ্রমিক মো. আবু তালেব (৪০)। জানালেন আকুতি।
তিনি বলেন, পানের বরজে কাজ করি প্রায় ২৫ বছর। চুরি, ডাকাতি তো করি না। শ্রমের টাকায় তিন সন্তানের সংসার চালাই। কর্মক্ষেত্রগুলো যদি ভেঙ্গে চুরমার করা হয়, আমরা কোথায় যাব? কি কাজ করব? আমরা নিজ ভূমিতে যেন প্রবাসী!
এদিকে, কষ্টের টাকায় গড়া পানের বরজ উচ্ছেদের প্রতিবাদে মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) দুপুরে বিক্ষোভ করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা। পানের ছড়া এলাকায় অনুষ্ঠিত পানচাষিদের বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। করোনার দুঃসময়ে বিনা নোটিশে পানের বরজ উচ্ছেদ সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অমানবিক দাবি করেছে তারা।
বনভূমি দখল করে শতশত ঘরবাড়ি ও স্থাপনা হলেও তাতে মাথা ব্যাথা নাই বনবিভাগের। পরিবেশবান্ধব পান চাষে কেন তারা খড়কহস্ত হলেন? প্রশ্ন এলাকাবাসীর।
তবে, সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন পানেরছড়া রেঞ্জ অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান টগর।
তিনি বলেন, পানেরছড়া বিটে ৩৩৯৭ একর বনভূমির ৬৬ একরের বেশি জমিতে অবৈধ দখলদার। যেখানে রয়েছে বসতঘর ও পানের বরজ। বনভূমিতে নতুন বরজ না করতে নির্দেশ আছে। সেটি জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবুও নির্দেশনা না মেনে যারা বরজ করছে সেগুলো উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
বনভূমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান রেঞ্জ অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান টগর।
ছোট ভাই ইমদাদুল হাসান রনির মাধ্যমে বরজ মালিকদের থেকে টাকা চাওয়ার অভিযোগটিও নাকচ করেছেন রেঞ্জ অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান টগর।
তিনি বলেন, ইমদাদুল হাসান রনি ফরেস্ট্রি থেকে ইন্টার্নি শেষ করেছেন। ১ বছর ধরে এফএওতে অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন।
বরজ মালিকদের নিকট থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। ভাবছিলাম মীমাংসা করব। এখন অভিযোগকারী সবার নামে মামলা দেব।
পাঠকের মতামত: